www.fgks.org   »   [go: up one dir, main page]

Amardesh
আজঃঢাকা, শনিবার ১৭ মার্চ ২০১২, ৩ চৈত্র্য ১৪১৮, ২৩ রবিউস সানি ১৪৩৩ হিজরী    আপডেট সময়ঃ রাত ১.০০টা
 
 সাধারণ বিভাগ
 বিশেষ কর্ণার
 শোক ও মৃত্যুবার্ষিকী
 সাপ্তাহিকী
 
আবহাওয়া
 
 
আর্কাইভ: --
 

জাসদের মিছিলে রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত ৫০

জাকির হোসেন
« আগের সংবাদ
পরের সংবাদ»
আজ ১৭ মার্চ। ১৯৭৪ সালের এই তারিখে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সৃষ্টি হয় এক কালো অধ্যায়। আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিতে এদিন পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে অন্তত ৫০ জনকে হত্যা করে। এতে জাসদ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবসহ দুই শতাধিক বিক্ষোভকারী গুরুতর আহত হয়। জাসদ নেতৃবৃন্দের মতে, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী নিহত অধিকাংশের লাশ গুম করে। তত্কালীন মুজিব সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও সীমাহীন লুটপাটের প্রতিবাদে জাসদের উদ্যোগে এদিন ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় ২৯ দফা দাবি আদায়ের প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সভা শেষে সন্ধ্যায় স্মারকলিপি প্রদানের জন্য মেজর এম এ জলিল ও আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে একটি মিছিল স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসবভনের উদ্দেশে রওনা দেয়। মিছিলটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির কাছে পৌঁছলে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর
নির্বিচারে গুলি চালায়। টানা প্রায় একঘণ্টা যাবত্ চলে এ বেপরোয়া গুলি বর্ষণের ঘটনা। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী বিক্ষোভকারীদের হত্যার পাশাপাশি চালায় গ্রেফতার অভিযান। এসময় পুলিশ জাসদ সভাপতি মেজর এম এ জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব, মহিলা সম্পাদিকা মমতাজ বেগম এবং জাসদ সমর্থিত কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনুসহ বেশ ক’জনকে গ্রেফতার করে। এদিন রাতে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনী জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। আর শেষ রাতে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী গণকণ্ঠ অফিসে তল্লাশি চালায় ও ছাপার জন্য তৈরি কপি, সিলোফিন প্রভৃতি আটক করে। ফলে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। পর দিন অর্থাত্ ১৮ মার্চ সকালে পুলিশ দৈনিক গণকণ্ঠ সম্পাদক আল মাহমুদকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। অন্যদিকে এদিন (১৮ মার্চ) আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে রাজধানীতে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিক্ষোভকারীরা ‘স্বাধীনতার শত্রুরা হুঁশিয়ারি’, ‘সমাজতন্ত্রের শত্রুরা হুঁশিয়ার’, ‘সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা বাংলা ছাড়ো’ ইত্যাদি সেম্লাগান সহকারে বিভিন্ন সড়ক প্রদিক্ষণ করে এবং বেলা ১২টার দিকে মিছিলকারীদের একাংশ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে।
এসব ঘটনা বিষয়ে ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি আমার দেশকে বলেন, আমরা সব সময়ই জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করেছি এবং মেহনতি মানুষকে বঞ্চনা থেকে মুক্তির দিতে লড়াই করেছি। আমরা বিএনপির জন্মের আগে আওয়ামী লীগের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। আবার বিএনপির জন্মের আগে জেনারেল জিয়ার বিরোধিতা করেছি। জিয়াউর রহমান বিশ্বাসঘাতকতা করে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি এবং আমাকে জেল দেয়। এ সত্ত্বেও পরবর্তীকালে স্বৈরাচারী এরশাদকে হটানোর জন্য আমরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে—ঐক্য করেছি। এরপর আমরা জঙ্গিবাদী বিএনপি-জামাতের হাত থেকে দেশকে রক্ষা এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৪ দল গঠন করি। অর্থাত্ আমরা সব সময়ই বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, ৩৫ বছর আগের ইতিহাস চর্চা করার সময় এখন নেই। আমাদের উচিত বর্তমান পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারায় যতদিন দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারা অব্যাহত থাকবে ততদিন রাজনীতিতে বিরোধী মত দমনের স্বৈরতান্ত্রিক ধারাও অব্যাহত থাকবে। সংবিধানকে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজনীতিকে দলতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে না পারলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। জবাবদিহিতা সৃষ্টি করতে না পারলে যে সরকারই আসুক না কেন এমন অবস্থা চলতেই থাকবে।
জেএসডি’র সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, এদিন আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশ বিনা উস্কানিতে গুলি চালিয়ে প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করে এবং অধিকাংশ লাশ পুলিশ গুম করে। তিনি বলেন, তত্কালীন মুজিব সরকারের আমলে টেন্ডার ও পারমিটবাজি, দ্রব্যমূল বৃদ্ধি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। এ লক্ষ্যে আমরা ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ পল্টনে এক জনসমাবেশের আয়োজন করি। এদিন সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে হাজার হাজার মানুষের একটি মিছিল স্মারকলিপি দেয়ার জন্য তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন মিন্টো রোডের দিকে রওনা দেয়। মিছিলটি পল্টন থেকে রওনা হয়ে মিন্টো রোডের কাছে পৌঁছলে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী বিনা উস্কানিতে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। প্রায় একঘণ্টা ধরে একটানা চলে এ গুলি। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর গুলিতে ছাত্রলীগ নেতা (জাসদ) জাফর, জাহাঙ্গীরসহ প্রায় পঞ্চাশজন নিহত হয়।
এসব ঘটনা ওই সময়ের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক সংবাদ এবং দৈনিক বাংলার বাণীতে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো—
আজ পল্টনে জাসদের জনসভা : শোষিত জনতার ২৯টি দাবি আদায়ের জন্য—
প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচি দেয়া হবে
স্টাফ রিপোর্টার
আজ ১৭ মার্চ, ঐহিহাসিক পল্টন ময়দানে জাসদ-এর জনসভা। শোষিত, নির্যাতিত, মেহনতী মানুষের মুক্তি তথা শোষক ও শোষণকে নির্মূল করার প্রত্যক্ষ কর্মসূচি। ঘেরাও আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যাপক সংগ্রামের যে সূচনা ঘটবে, শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে বলে জাসদের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এদেশের মেহনতী মানুষের পক্ষ থেকে ২৯টি দাবি পেশ করার পর বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরে দাবি আদায়ের পক্ষে মেহনতী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পরিলক্ষিত হয়। জাসদ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন পর্যায়ে দেশের আনাচে কানাচে সফর করেছেন, জনসভা করেছেন। দেশের সর্বত্র জনতা দাবি আদায়ের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত রায় দিয়েছেন। শপথ নিয়েছেন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দাবি ছিনিয়ে নেয়ার। আজকের দিনটি তাই জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছেন।
উল্লেখযোগ্য, এই পল্টনের লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে এদেশের শোষিত নির্যাতিত জনগণের ন্যূনতম যে ২৯টি দাবি পেশ করা হয়েছিল, ক্ষমতাসীন চক্র শেষ সময়ের মধ্যেও তা মেনে নেয়নি। অন্ন-বস্ত্র সঙ্কটে জর্জরিত মেহনতী মানুষের ন্যূনতম দাবিগুলোর প্রতি সীমাহীন উপেক্ষা প্রদর্শন করে ক্ষমতাসীনরা তাদের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, শোষণ-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। বিদেশী শক্তির নির্লজ্জ তাঁবেদারির ফলশ্রুতি হিসেবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আজো তিরোহিত হয়নি। দেশের এবং দেশবাসীর এই ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল আজ জনতার পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
ক্ষমতাসীন চক্র তাদের কার্যকলাপে ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী শক্তির মাধ্যমে ছিনিয়ে না নিলে আপোষে মেহনতি জনতার দাবি মেনে নিবে না। এদেশের শোষিত মেহনতি জনতা ক্ষমতাসীন চক্রের চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত মোকাবিলা কারবে এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে আনবে বলে জাসদ ঘোষণা করেছে। আজ পল্টনে জাসদ নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে ঘোষিত হবে জনতার দাবি আদায়ের সংগ্রামের প্রত্যক্ষ কর্মসূচি। জনগণের শোষণ মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে সতেরই মার্চ উনিশ শ’ চুয়াত্তর এক অযুত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে শোষিত মেহনতি জনতার সম্মুখে আজ সমাগত। ঐতিহাসিক সতেরোই মার্চ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অস্থিরতম রাজনৈতিক দিনগুলোর যবনিকা ঘটবে, আজকেই ঘোষিত হবে শোষণ মুক্তির সংগ্রামের প্রত্যক্ষ কর্মসূচি। (দৈনিক গণকণ্ঠ : ১৭ মার্চ ১৯৭৪)
জাসদ-এর ঘেরাও : গুলীবর্ষণে নিহত ৫
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
জাসদ আহূত ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ঘোষণার’ প্রথম দিবসে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় মেজর এমএ জলিল ও আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে মিছিলসহ স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করা হয়। ক্ষিপ্ত জনতা মন্ত্রীর বাড়িতে ঢুকে পড়তে চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। গোলযোগের এক পর্যায়ে সেখানে লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস ও পরে রক্ষীবাহিনী-পুলিশের গুলীবর্ষণে ৫ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। আহতদের মধ্যে জাসদ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবও রয়েছেন। গুলীবর্ষণ ঘটনার পরই পুলিশ জাসদ সভাপতি মেজর এমএ জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব, মহিলা সম্পাদিকা মমতাজ বেগম এবং জাসদ সমর্থিত কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনুসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। নিহত ব্যক্তিদের একজন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মারা যান। তাঁর নাম সফিউল্লাহ। তিনি ওয়াপদার ‘পেইন্টার’। অপর একজন মোজাম্মেল হক (ছাত্র)। আরেকজন অজ্ঞাতনামা; তার বয়স ৩০ বছর। নিহত চতুর্থ ব্যক্তিও ছাত্র, নাম প্রদীপ চন্দ্র পাল। তিনি হোমিও মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং নিহত পঞ্চম ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মোট ১৫ জন আহতকে ভর্তি করা হয়। অপরদিকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে অপর ৩ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এখানে মুকুল দেশাই নামে ইডেন কলেজের একজন ছাত্রীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তাঁরা হচ্ছেন রোজী, মিনু, লিনু, বানু ও মিথুন নামের ৫ ছাত্রী। জনাব নাজিরুদ্দীন, ফিরোজ, হাসান আলী, বাদল (ঘাড়ে গুলীবিদ্ধ), সাত্তার, বুকে গুলী লাগা আরেকজন অচেতন ব্যক্তিও রয়েছেন।
জাসদ-এর প্রতিবাদ : গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে আজ সোমবার বিকেলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ঢাকার বায়তুল মোকাররমে সমাবেশে এবং আগামীকাল সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেছে।
পল্টনে জনসভা : পূর্বাহ্নে পল্টন ময়দানে আহূত জনসভায় গতকাল রোববার বিকেল থেকে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র পর্যায়ক্রমিক ঘেরাও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এবং জাসদ সভাপতি জনাব এমএ জলিল প্রাথমিক কর্মসূচি হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও-এর কথা ঘোষণা করেন। সভায় জাসদের সাধারণ সম্পাদক জনাব আ স ম আবদুর রব ঘেরাও কর্মসূচি হিসেবে আগামী ৮ই এপ্রিলের মধ্যে রক্ষীবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র সমেত ব্যারাক ও ক্যাম্প ছেড়ে চলে আসার অনুরোধ জানান। অন্যথায় এর পরে কোনো গুলী চালালে দেশে আগুন জ্বলবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
তিনি বলেন, আজ থেকে ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন’ শুরু হলো। তিনি কৃষকদের লেভি প্রদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আগামীকল থেকে লেভি যারা আদায় করতে যাবে, তাদের মাথা রেখে দেবেন। তিনি প্রথমে গ্রাম থেকে গণপিটুনি শুরুর আহ্বান জানান। জাসদ সভাপতি জনাব এম এ জলিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন জাসদ সহ-সভাপতি শ্রী বিধান কৃষ্ণ সেন, জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জনাব মো. শাহজাহান ও যুগ্ম সম্পাদক জনাব শাহজাহান সিরাজ।
সভায় গৃহীত ঘেরাও আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা ও তাঁর দফতর ঘেরাও। এরপর সরকারদলীয় রিলিফ চেয়ারম্যান, গাড়ি-বাড়ি, সম্পত্তি ও কল-কারখানার দখলদার টিসিবি, ভোগ্যপণ্য সরবরাহ কর্পোরেশন, রেশন অফিস, আমাদানী-রফতানী অফিস, জেলখানা ভেঙে বন্দীদের মুক্তি ও গণভবন ঘেরাও। (দৈনিক সংবাদ : ১৮ মার্চ, ১৯৭৪)
সরকারী প্রেসনোটে গুরুতর অভিযোগ
: উন্মত্ত মিছিলকারীরা প্রথমে গুলী চালায়
গতকাল রোববার বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিম্নোক্ত প্রেসনোট প্রকাশ করে : ‘দীর্ঘদিন যাবত্ সরকার চরম সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে জাসদ-এর পরিচালিত হিংসাত্মক রাষ্ট্রবিরোধী তত্পরতা লক্ষ্য করে আসছে। এই দলটি তাদের সভাগুলোতে অব্যাহতভাবে জনগণের ইচ্ছানুসারে ও আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উত্খাতের জন্য হিংসাত্মক পন্থার কথা প্রকাশ্যে প্রচার করছে। তারা জনগণকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে উস্কানি দিচ্ছে এবং সশস্ত্র গোলযোগ ফেনিয়ে তোলার জন্য পরিস্থিতির পর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে।
এছাড়া তারা দেশের সমগ্র যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত করার একটি কর্মসূচিও ঘোষণা করে। আজ রোববার পল্টন ময়দানে জাসদ সশস্ত্র গোলযোগের মাধ্যমে আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উত্খাতের জন্য তাদের কর্মসূচি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে এক জনসভা অনুষ্ঠান করে এবং ধ্বাংসাত্মক লক্ষ্যের পদক্ষেপ হিসেবে তারা সচিবালয় ও অন্যান্য সরকারী দফতর, বেতার ও টিভি কেন্দ্রসমূহ, সংবাদপত্র কার্যালয়সমূহ এবং মন্ত্রীবর্গ, প্রতিমন্ত্রীবর্গের সরকারী বাসভবন, এমনকি গণভবন আক্রমণের লক্ষ্য ঘোষণা করে।
হিংসাত্মক কার্যক্রমের কর্মসূচি ঘোষণার পর জাসদ নেতৃবৃন্দ আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনে নিয়ে যায় এবং ঘেরাও ও হামলা করে। আক্রমণকালে তারা হিংস্রতায় লিপ্ত হয় এবং তথায় কর্তব্যে নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কয়েকজন কর্মচারীকে গুরুতরভাবে আহত করে। মিছিল নিয়ে পথ অতিক্রমকালে তারা কয়েকটি সরকারী ও বেসরকারী যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রথমে নেতৃবৃন্দ ও মিছিলকারীদের হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ থেকে নিবৃত্ত হবার জন্য সতর্ক করে দেয়, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে হিংসাত্মক মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য লাঠিচার্জ করতে হয়। কিন্তু মিছিলকারীরা আরো উন্মত্ত হয়ে ওঠে এবং কর্তব্যরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের ওপর গুলী চালায়, ফলে তাদের কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আর কোনো গত্যন্তর না থাকায় তাদের গুলীবর্ষণ করতে হয়। এর ফলে তিনজন মিছিলকারী নিহত ও ১৮ জন আহত হয়। ৪০ জন মিছিলকারীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের অধিকাংশকেই ঘটনাস্থলে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণাধীন। (দৈনিক সংবাদ : ১৮ মার্চ, ১৯৭৪)
সম্পাদক গ্রেফতার
গতকাল গণকণ্ঠ বেরোয়নি
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
দৈনিক গণকণ্ঠ সম্পাদক জনাব আল মাহমুদকে গতকাল সোমবার সকালে ঢাকায় তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। গতকাল সোমবার দৈনিক গণকণ্ঠ বের হয়নি। গত পরশু রোববার শেষ রাতে দৈনিক গণকণ্ঠের অফিসে পলিশ ও রক্ষীবাহিনী তল্লাশি চালায় ও ছাপার জন্য তৈরি কপি, সেলোফিন প্রভৃতি আটক করে বলে জানা যায়। (দৈনিক সংবাদ : ১৯ মার্চ ১৯৭৪)
জাসদ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
‘স্বাধীনতার শত্রুরা হুঁশিয়ার’, ‘সমাজতন্ত্রের শত্রুরা হুঁশিয়ার’, ‘সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা বাংলা ছাড়ো’ প্রভৃতি শ্লোগান সহকারে লাঠিধারী বিক্ষুব্ধ জনতার এক বিরাট মিছিল গতকাল বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক পরিক্রমণ করে। মিছিলকারী জনতা বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে কেন্দ্রীয় জাসদ অফিসের সামনে এসে তুমুল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং জাসদ অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় জাসদ কেন্দ্রীয় অফিসে দলের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। অগ্নিসংযোগের ঘটনার অব্যবহিত পরেই সশস্ত্র বিডিআর ও পুলিশ দল ঘটনাস্থলে আগমন করে। কিন্তু এর আগেই বিক্ষুব্ধ জনতা চলে যায়। পুলিশের আগমনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দমকল বাহিনীর লোকেরাও দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয় এবং আগুন আয়ত্তে আনে। অগ্নিসংযোগের ফলে জাসদ অফিসের আসবাবপত্র ও হার্ডবোর্ড দেয়া প্রাচীরগুলো জ্বলে যায়। এছাড়া দরজা-জানালারও ক্ষতিসাধিত হয়। (দৈনিক সংবাদ : ১৯ মার্চ ১৯৭৪)
নেতারা পালিয়ে যান : কেউ হতাহত হননি
জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভস্মীভূত
(স্টাফ রিপোর্টার)
গতকাল দুপুর বারটার দিকে একটি বিরাট জঙ্গী শোভাযাত্রা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় দফতরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এতে কেউ হতাহত হয়নি। জাসদ নেতারা বিক্ষুব্ধ শোভাযাত্রা দেখে পালিয়ে যান। আমাদের সংবাদদাতা জানান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের এই অফিসটি কর্মচঞ্চল বঙ্গবন্ধু এভিনিউর একটি পরিত্যক্ত দ্বিতল ভবনে অবস্থিত।
গত ১৭ মার্চ পল্টন ময়দান থেকে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ একদল লোক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন আক্রমণ করার প্রতিবাদে গতকাল সার্কিট হাউস আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে একটি সভা ঢাকা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংসদ সদস্য জনাব গাজী গোলাম মোস্তফা। সভায় বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক। জনাব রাজ্জাক ঘোষণা করেন, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, জাসদ নেতারা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। তিনি গত পরশু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে হামলার নিন্দা করে বলেন, ওরা যেখানে গুলী ছুড়েছে, পুলিশকে আক্রমণ করেছে এবং চীন-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চর হিসেবে চরম উস্কানী প্রদান করেছে। তিনি দেশপ্রেমিক জনগণকে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য আহ্বান জানান।
সভাশেষে শোভাযাত্রা
সভাশেষে একটি বিরাট শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণে বের হয়। মিছিলের অগ্রভাগে অন্যদের মধ্যে ছিলেন জনাব গাজী গোলাম মোস্তফা, জনাব তোফায়েল আহমেদ ও জনাব আব্দুর রাজ্জাক। মিছিল আওয়ামী লীগ অফিস থেকে মিন্টো রোড হয়ে রমনা গ্রীন দিয়ে বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে তোপখানা রোড অতিক্রম করে। মূল শোভাযাত্রা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এলে বিপুলসংখ্যক পথচারী মিছিলে যোগদান করে এবং মূল মিছিলটি নবাবপুর হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়। জিপিও অফিসের সামনে আসতেই মিছিলের একটি অংশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাইনবোর্ড দেখে আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং মূল শোভাযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেখানে ঢুকে পড়ে। তারপরই জাসদ অফিস থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। দমকল বাহিনীর লোকেরা এসে আগুন নিভিয়ে দেয়। (দৈনিক বাংলার বাণী : ১৯ মার্চ ১৯৭৪)